ভূমিকা:
দেশের
দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে সামরিক শাসনাধীন । পার্বত্য চট্টগ্রাম পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সামরিকায়িত অঞ্চল যেখানে প্রতি এগার জন সাধারণ পাহাড়ির পিছনে একজন অস্ত্রধারী
সৈনিক নিয়োজিত রয়েছে ।
( সূত্র: আল জাজিরা ,২৪ জুন
২০১৫ ও
ইউএনপিও, ২৯ জুন ২০১৫)
দেশের এক দশমাংশে সামরিক শাসন জারি রেখে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে । গণতান্ত্রিক রীতি নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা থাকলে রাষ্ট্রীয় নেতারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ দশকের সামরিক শাসন নিয়ে আক্ষেপ ও অনুতপ্ত হতেন । কিন্তু, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় শাসকদের অবস্থা যেন রূপকথার দানবের পৈশাচিক উল্লাস ।
সামরিকায়ণ:
পার্বত্য
চট্টগ্রাম ভূকৌশলগত অবস্থান দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা বাংলাদেশ, ভারত ও
মায়ানমারকে সংযুক্ত করেছে । এই অঞ্চল প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ- পাথর, কয়লা, তামা ও
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ ।
এছাড়া খনিজ তেল,
বনজ সম্পদ – গাছ,বাঁশ, বনজ ওষধি ও দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ- প্রাণী
সম্পদে সমৃদ্ধ ।
বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ১৯৯৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঠ ব্যবসার মূল্য দাঁড়িয়েছিল
প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার । (সূত্র : জীবন আমাদের নয় ,পার্বত্য
চট্টগ্রাম কমিশন রিপোর্ট, আপডেট-৩ )
১৯৮০
সালে সৌদি আরব ও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তেল
অনুসন্ধানের জন্য জন্য ৯.২ মিলিয়ন ডলার এবং ২৩ মিলিয়ন ডলার ঋণপ্রদান করে । এবং ১৯৮১ সালে আমেরিকান
শেল কোম্পানি পেট্রো বাংলার সাথে যুক্ত হয়ে ২৫ বছরের একটি সমঝোতা চুক্তি করে তেল
অনুসন্ধান শুরু করে। বাংলাদেশ
সরকার এ জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার বোনাস পায় এবং
শেল কোম্পানি ১২০
মিলিয়ন ডলার
বিনিয়োগে রাজি হয় । [ Source: Anti-Slavery Society 1984:40] কিন্তু ১৯৮৪ সালে তেল অনুসন্ধানের সময়
শেল কোম্পানীর কর্মকর্তা অপহৃত হলে এই অনুসন্ধান প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায় ।
১৯৭৬
সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন । এই বোর্ড বৈদেশিক অনুদানের সাহায্যে
পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প কর্মসূচি গ্রহণ করে । এই কর্মসূচি ১৯৭৯ তে শুরু হয়ে ১৯৮৭
শেষ হওয়ার কথা ছিল।
এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে
মোট ৪১.৮ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল যা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট
ব্যাংক ২৮.৫ মিলিয়ন ও
ইউএনডিপি ০.৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়
। এই প্রকল্প আবার ১৯৮৩ সালে এসে ১৯৯৩
সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
এই সময় মোট
সংশোধিত বাজেট ছিল ১,৩৮০.০৪ কোটি টাকা । এই সংশোধিত
বাজেটের ৭০৮.৫ কোটি টাকা এডিবি এবং ইউএনডিপি যৌথভাবে সরকারকে প্রদাণ করে । এছাড়াও সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের
অর্থপুষ্ট এনজিও আল রাবিতা,
সিডা (The Swedish
International Development Authoriy), হু (World Health
Organization), ইউএসএইড
( United States Agency For International Development) ইত্যাদি দেশি-বিদেশি এনজিও সংস্থা সরকারকে প্রচুর ঋণ দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পার্বত্য
চট্টগ্রামে সামরিকায়ণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে ।
এই সময়ে সরকারে সামরিক খাতে প্রচুর বাজেট বৃদ্ধি পায় । ১৯৭৫ সালে সামরিক বাজেট
ছিল ৪২ মিলিয়ন ডলার , ১৯৭৬ সালে ৮৬ মিলিয়ন ডলার , ১৯৭৭ সালে ১৩৬ মিলিয়ন ডলার,
১৯৭৮ সালে ১৪ মিলিয়ন ডলার, ১৯৮০ সালে ১৩৮ ডলার করা হয় । (Source: The Chittagong Hill Tracts Militarization,oppression and the hill tribes by Anti slavery
Society)
১৯৮৮-১৯৯১
পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া একটি বৈদেশিক সহযোগিতার
উপাত্ত :
FOREIGN
AID TO BANGLADESH BY PRINCIPAL DONORS
(in Million US$)
দাতার নাম |
১৯৮৮-৮৯ |
১৯৮৯-৯০ |
১৯৯০-৯১ |
জাপান |
৩৪০ |
৩৩৫ |
৩৪০ |
এ ডি বি |
৩০০ |
২৭৪ |
২৯০ |
আই ডি এ |
২৯৭ |
৪৬৩ |
৩৩৪ |
কানাডা |
১১৯ |
১০৪ |
১১২ |
ইইসি |
৬৬ |
৪৭ |
৫৩ |
ইউএসএ |
৯৫ |
১০০ |
১০২ |
এফ আর জার্মানি |
৫৭ |
৫০ |
৫৫ |
নেদারল্যান্ডস |
৫২ |
৪৩ |
২৭ |
যুক্তরাজ্য |
৪৪ |
৫২ |
৩১ |
জাতিসংঘ ( ইউনিসেফ
ব্যতীত ) |
৬৬ |
৫৮ |
৯৯ |
ইউনিসেফ |
২৫ |
২৪ |
– |
সুইডেন |
৩১ |
৩৭ |
২২ |
ডেনমার্ক |
১৮ |
৫১ |
৩৩ |
নরওয়ে |
২৫ |
৩৫ |
২০ |
সৌদি আরব |
১৫ |
৮ |
Foreign
aid to Bangladesh;Source: Angelfire.com
এই বিদেশি সংস্থার অর্থে সামরিক সরকার ১৯৭৮ থেকে
১৯৯০ সাল নাগাদ পার্বত্য
চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলা সদর,খাগড়াছড়ি সদর,দিঘীনালা, বান্দরবান সদরে ৪ টি সেনাবাহিনীর
ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার, ঘাগড়া ,রুমা ও আলীকদমে সেনা গ্যারিসন, কাপ্তাইয়ে ৩টি
গানবোটসহ নেভাল বেস, ২৩ টি আর্মি জোন, ৩ টি বাংলাদেশ রাইফেলস জোন(বিজিবি), মহালছড়িতে ১ টি এন্টি গেরিলা ট্রেনিং সেন্টার চালু
করে
। এছাড়াও উপর ২৩০ টি আর্মি ক্যাম্প , ১ টি বিডি আর ক্যাম্প ও ৮০ টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ।
`The Anti-Slavery Society` ১৯৮৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮০-৮৪ সাল পর্যন্ত ৩০,০০০ নিয়মিত সৈন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে
মোতায়েন করা হয় যা ছিল পুরো দেশের সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ । [Source : Anti-Slavery
Society 1984:57].
এই সময় পার্বত্য
চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনী গেরিলাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য বিদেশী সমর বিশেজ্ঞদের আনা হয়েছিল । ১৯৮৩
সালে বৃটিশ লেবার পার্টির সদস্য Alf Dubbs স্বীকার করছেন যে , ‘‘It became known that the British Royal
Army presence was maintained at the Defence Staff College, Savar... headed by
Col. Givson Of SAS, the Sepecial
Armed Service .”
SAS হচ্ছে
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি ইন্সার্জেন্সী ইউনিট যা মালয় কমিউনিস্টদের বিদ্রোহ দমন ও
হত্যাকান্ডে ব্যবহার হয়েছিল । পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক অভিযানের জন্য পুরো
অঞ্চলকে সাদা,সবুজ ও লাল এলাকায় বিভক্ত করে সামরিক কৌশল গ্রহণ করা হয় । সার্বিক
দায়িত্বে থাকেন চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ।
১৯৭৯
সালের ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জু খাগড়াছড়িতে এক সমাবেশে ঘোষণা দেন –,“আমরা তোমাদের চাই
না। তোমরা
যেখানে ইচ্ছা যেতে পার কিন্তু আমরা তোমাদের জায়গা চাই।“
এই
সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী কাউন্টার
ইন্সার্জেন্সীর নামে পাহাড়ি জনগণের উপর চরম দমন পীড়ন চালায় ।
সেনাবাহিনী কাউখালি, লংগদু ,লোগাং,
নানিয়াচর, মাটিরাঙা সহ বিভিন্ন জায়গায় ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত করে ।
এসময় হাজার হাজার পাহাড়ি পার্শ্ববর্তী রাজ্য মিজোরাম ও ত্রিপুরায় শরনার্থী যেতে
বাধ্য হয় ।
মানবমিত্র সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্সার্জেন্সীর কলাকৌশলকে
সামরিক, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও সামাজিক এই প্রধান চার ভাবে ভাগ করে বিশ্লেষণ করেন
।
অর্থনৈতিক
কৌশলের মধ্যে রয়েছে (ক) পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং যৌথ খামার, আদর্শ গ্রাম ও
গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তর এবং (খ) কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি ।
জার্মান
নৃতত্ত্ববিদ এল জি লফলার ১৯৯১ সালে বান্দরবান ও রাঙামাটি সফরে গিয়েছিলেন । সফর শেষে তিনি লেখেন :
“Once upon a time, the Chittagong Hill Tracts were not only
rich in timber and bamboo, but they also produced a surplus of paddy and
cotton. Hard-working farmers were … comparatively well off, and really needy
people were few in number. Nowadays, after millions of dollars of development
aid have been spent needy people abound, rice and cotton have to be imported,
and timber and bamboo have become so scarce that the formerly magnificent
houses of the indigenous people gave way to poor huts.”
[এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল বাঁশ ও গাছ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল
না, উপাদিত ধান- তুলারও
উদ্ধৃত থাকত । কঠোর পরিশ্রমী কৃষকরা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিলেন। আর অভাবী মানুষের
সংখ্যা ছিল খুবই কম । উন্নয়ন সাহায্য লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করার পর আজ অভাবী মানুষের
সংখ্যা হয়েছে প্রচুর, চাল ও তুলা আমদানি করতে হচ্ছে এবং গাছ ও বাশেঁর এত সংকট যা আগেকার আদিবাসী
জনগণের সুন্দর ঘরগুলোর জায়গা নিয়েছে জীর্ণ
শীর্ণ কুঠির ।]
পার্বত্য চুক্তির পর ১৯৯৮-২০০৪ সালে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল স্বপন আদনান লফলারের উপরিউক্ত পর্যবেক্ষণকে
সমর্থন করেন । তিনি বলছেন :
“Our fieldwork in the CHT over 1998-2002 indicated that many
of the observations made by Loffler (in 1991) regarding the deterioration in
the living condition of the Hill peoples had been contining unabated.”
[১৯৯৮ থেকে
২০০২ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে
আমাদের মাঠের কার্যক্রম এটা ইঙ্গিত দেয় যে, পাহাড়ি জনগণের
জীবনযাত্রা সম্পর্কে লফলার যে মন্তব্য করেছিলেন (১৯৯১ সালে)
তার বহুলাংশ এখনো সঠিক
রয়েছে ।
]
স্বপন আদনান পাহাড়িদের মধ্যে দারিদ্রতা সৃষ্টির জন্য চারটি প্রধান মেকানিজমকে দায়ী করেন এবং বলেন :
“Nevertheless,
the most critical factor underly the economic subordination of the Hill peoples
has been their lack of political power. … These fundmamental inequalities in
economic position and political power have also provided the bases of ethnic
conflict in the CHT and stoked the resistance of the Hill peoples against
economic exploitation and political domination.”
পাহাড়িদের মধ্যে দারিদ্রতা সৃষ্টির জন্য স্বপন আদনান চারটি প্রধান মেকানিজমকে দায়ী করেন এবং বলেন :
পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে যেসব দেশি বিদেশি সংস্থার বিনিয়োগ
হয়েছে তা সাড়ে চার লাখের অধিক সেটেলার বাঙালি পূর্ণবাসন, আদর্শ গ্রাম-গুচ্ছ গ্রামের নামে পাহাড়িদের ‘‘Detention
Center’’, `Concentration Camp` এ রাখা, নতুন নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন , রাবার বাগান-সরকারি বনায়ণ প্রকল্প , সেনা যাতায়তের ( সামরিক অপারেশন) সুবিধার জন্য নতুন রাস্তাঘাট ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে । এর মধ্যে অনেক সামরিক কর্মকর্তা অর্থসাৎ ও প্রমোশন বানিজ্যে লাভবান হয়েছে । অন্যদিকে পাহাড়িরা অর্থনৈতিক-সামরিক শাসন শোষণের যাতাকলে পরে সর্বস্ব হারিয়েছে ।
পার্বত্য
চুক্তি পরবর্তী সামরিক শাসন
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এখনো কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি বন্ধ হয়নি । এবং পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প, সেনা শিবির- ছাউনি প্রত্যাহার করে ব্যারাকে ফিরে নেওয়ার কথা থাকলে সেগুলো এখনো পূর্ণবহাল রয়েছে । এবং চুক্তি পরবর্তী সময়ে সরকার `অপারেশন উত্তরণ` জারি রেখেছে । চুক্তি পরবর্তী পাহাড়িদের উপর ১৭ টির অধিক সাম্প্রদায়িক হামলা ও ভূমি বেদখলে সেনারা সরাসরি জড়িত ছিল ।
সর্বশেষ, ২০১৫ সালে ১১
জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১দফা নিদের্শনা জারি করেছে যা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে
বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে । যা উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগনের গণবিরোধী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আফসা (Armed Forces Special Powers Act-1958) আইনের একটি
দেশীয় সংস্করণ । ১১ দফা নির্দেশনা পার্বত্য
চট্টগ্রামের জনগণকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে । (সূত্র : আল
জাজিরা ,২৪ জুন ২০১৫)
সামরিক বাহিনী কতৃক ব্যাপকভাবে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা কর্মীদের পাশাপাশি ব্যাপক সাধারণ জনগণ, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষকদের গণহারে গ্রেফতার-নির্যাতন ,হত্যা এবং গুমের মতন ঘটনার সাথে জড়িত । সেনাবাহিনী নতুনভাবে ঠ্যাঙারে বাহিনী (Vigilante group ) তৈরি করে জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে ।
এবং এই বছরের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুনভাবে দেশে বিদেশে বিতর্কিত র্যাবের পার্বত্য ব্যাটেলিয়ন র্যাব -১৫ নামে ( ৬৭৭ জন সদস্য ) মোতায়েন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।
গতবছর ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ এ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন খাগড়াছড়িতে গিয়ে নতুনভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশ –আনসার ক্যাম্প নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন । এবং ইতিমধ্যে নতুন করে ২০ টি`র অধিক সেনা ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক কতৃত্ব জিইয়ে রাখতে বিভিন্ন ট্যুরিস্ট জোনে ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন ও ভিডিপি-গ্রাম পুলিশের কয়েক হাজার সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিয়ে রিজার্ভ রাখা হয়েছে ।
বর্তমানে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সাজেক ,নীলাচল, নীলগিরি পর্যটন ব্যবসা থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করছে । এসব টাকা পকেটস্থ করছে কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা । এবং সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনী বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়ের রেঞ্জে ম্রো জাতিসত্তাদের ১০০০ একর জমি দখল করে ৩৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে পাচঁ তারকা হোটেল ম্যারিয়ট নির্মাণে বিতর্কিত সিকদার গ্রুপের সাথে যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে । এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিবেশ বিরোধী গাছ-বাশঁ বনজের মতন মূল্যবান সম্পদ আহরণ, পাথর উত্তোলন, ইটভাটা, ঠিকাদারি ব্যবসার সাথে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত ।
মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এক ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত রয়েছে । পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এই প্রভাব সমতলে ও এসে পড়েছে । প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে সেনাবাহিনী ১৪৭ টি উপর পণ্য ব্যবসার সাথে জড়িত । এটা অনেকটা ``Butterfly effect`` এর মতন যা ছোট কিছু মনে হয় মনে হয় কিন্তু এর বড় আকারের প্রভাব রয়েছে ।
বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব সামরিক কর্মকর্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন কায়েমে জড়িত ছিলেন পরবর্তীরা এসব সামরিক কর্মকর্তারাই পুরো দেশব্যাপী সামরিক শাসন কায়েম করেছে । অর্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে সামরিক শাসনের পরীক্ষাগার ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ণে রাষ্ট্রের যেমন অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে তেমনি এই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পাহাড়ি জনগণের নিজস্ব প্রতিরোধ সংগ্রামও গড়ে উঠেছে । ভূমি বেদখল, জাতিগত নিপীড়ণ, নারী ধর্ষণ- নিপীড়ন বৃদ্ধির সাথে সাথে লড়াই ও তীব্রতর হয়েছে ।
মহামতি
ফ্রিডরিক এঙ্গেলস এর মতে,
``যে জাতি অন্য জাতিকে শোষণ করে সে জাতির জনগণ নিজেরা ও মুক্ত নয়
।``
তাই
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ পাঁচ দশকের সেনা শাসন অবসানে পাহাড়ের নিপীড়িত জাতিসমূহের
সাথে সমতলের নিপীড়িত জনগণ ও প্রগতিশীল শক্তির পারস্পরিক
সহযোগিতা, সহমর্মিতা জরুরি হয়ে পড়েছে ।
আমরা দেখেছি-
মুক্তিকামী ভিয়েতনামী
জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার যুদ্ধের সময় খোদ আমেরিকা শহরগুলো অবরোধ করে ছাত্র-যুবকদের যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হয় ।
পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করে । কিন্তু যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের ডানা তীব্রতর হলে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন ভিয়েতনাম
থেকে
মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় ।
দেশ
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন অবসানে আমরা এমন ভূমিকা সমতলসহ দেশে-বিদেশের প্রগতিশীল ব্যাক্তি,
সংগঠন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকলের কাছে প্রত্যাশা রাখি ।
চলবে….
তথ্যসূত্র :
১.পার্বত্য চট্টগ্রামে
অর্থনৈতিক শোষণ ও প্রান্তিকীকরণ- রবীন মেন্দর ।
২.পার্বত্য চুক্তি প্রসঙ্গে
– বাসদ
৩.জীবন আমাদের নয়-পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন
৪. Winning Hearts and
Minds: Foreign Aid and Militarisation in the Chittagong Hill Tracts Author(s): Janneke Arens
৫.Insurgent Crossfire –Subir
Bhaumik
৬. পার্বত্য চট্টগ্রামে
পর্যটন আশির্বাদ না অভিশাপ – আর এস ত্রিপুরা ।