Back to the Hill ~পাহাড়ে ফিরে চলো

M.N LARMA,MITHUN CHAKMA LIVES,THE BATTLE CONTINUES...

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

পাহাড়ের ‘‘ম্যান অব প্রিন্সিপলের‘‘ মহাপ্রয়াণ

0 comments

 



সপ্তম শ্রেণিতে পড়তাম । খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াছড়ি সরকারি স্কুল । দুটো শিফটে স্কুল চলত, এখনো চলে । আমি মর্ণিং এ ছিলাম । তখন সকাল সকাল দৌড়, ক্লাস এবং শেষে আবার বাসার দিকে দৌড় । স্কুল থেকে ফিরেই খেলাধুলা আর বইয়ে মুখ গুজে দিতাম । একাডেমিক পড়ার বাইরে কোনো গল্প-তল্প-কবিতার বই পড়া হতো না । তবে ম্যাগাজিন পড়া হত । ভালো লাগত কৌতুক,গল্প,। স্কুল থেকে বার্ষিক ম্যাগাজিন বেরুত । ‘নিসর্গ’, ‘গৈরিকা’ ‘স্পন্দন’ নানা নাম দেওয়া হত এগুলো । ম্যাগাজিনে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীলতায় ভরপুর গল্প, কৌতুক, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতিচারণ লেখা থাকত । লেখাগুলো ভালো লাগলে বার বার পড়া হত । এরকম একটি লেখার সাথে পরিচয় ঘটে আমার প্রিয় স্কুলের একসময়ের ছাত্র ও শিক্ষক এ.বি. খীসা স্যারের সাথে । স্কুল নিয়ে তাঁর একটি স্মৃতিচারণ লেখায় । স্মৃতিচারণটি কিছু কিছু মনে আছে । আজ থেকে ১১ বছর আগে পুরোপুরি মনেও থাকার কথা নই । ওই লেখার ম্যাগাজিন ও হারিয়ে ফেলেছি । আমি ভাবতাম, এই বৃদ্ধ-বয়স্ক লোকটাকে তো স্কুলে কখনো দেখেনি কিন্তু স্কুল ম্যাগাজিন তারঁ লেখা অনবরত ছাপিয়ে যাচ্ছে । অনেক পরে জেনেছিলাম কেন স্কুল ম্যাগাজিনে উনার লেখা ছাপা হত । এবং পরে উপলব্ধি হয়েছে উনার লেখা ছাপিয়ে- সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে মূল স্কুল গড়ার কারিগরকে তারঁ হাতের স্পর্শে , সারা জীবনের প্রাণ-প্রাচুর্য শক্তি দিয়ে গড়া স্কুলটি তাকেঁ যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে যাচ্ছে । শুধুমাত্র শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে এই গুণী ও জ্ঞানী মানুষের কত বড় অবদান । যাঁকে এক কথায় বলা যায় ``ম্যান অব প্রিন্সিপল ``। তাকেঁ বাদ দিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান, একটা জনপদের সময়কে ধরা যায় না, বুঝা যায় না ।


সর্বশেষ ১৬’ সালে স্কুলের ১ম পুর্ণমিলনী অুনষ্ঠান হয় । এই উপলক্ষে ‘সম্মিলন’ নামে ম্যাগাজিন বের হয় । ম্যাগাজিনের প্রথম লেখাই শ্রদ্ধেয় এ.বি. স্যারের (১৭-১৯ পৃষ্ঠা) । আড়াই পৃষ্ঠার দুর্দান্ত লেখা । এই লেখার মধ্যে দিয়ে একটা অঞ্চলকে চলমান ইতিহাসের গভীরে গিয়ে শিকড় অনুসন্ধানের দায়বোধ থেকে তিনিই যেন মুক্তি দিয়েছেন । লেখক নিজেই বিশিষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এবং একটা জনপদের ইতিহাস হয়ে উঠেছেন । ব্যাক্তি অনেক সময় সময়কে ধারণ করতে পারার মধ্যে দিয়ে যেন ইতিহাস পাঠের মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠেন ।

তিনি ‘‘একটি বিশিষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বিষয়ক বিশীর্ণ বয়ান’ দিচ্ছেন এভাবে- ‘‘আমার শৈশব ছাত্রজঅবনের ৪ বছরের এক মূল্যবান সময় এবং কর্মজীবনের অধিকাংশটাই সেই সুদীর্ঘ সিকি শতাব্দীকাল কেটেছে এই
ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠে । সেই বৃটিশ আমলে ১৯৪৫ সালে আমি বিদ্যালয়টিতে ভর্তি হয়েছিলাম তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে ।তখন বিদ্যালয়টি ছিল একটি মিডল ইংলিশ স্কুল .................................বিদ্যালয়টি ছেড়ে যাওয়ার বহু বছর পর এক সময় ঘটনাক্রমে বিদ্যালয়টিতে আমার আবার পর্দাপন ঘটে যায় অন্য এক বেশে , অন্য এক ভূমিকা নিয়ে, বিদ্যালয়টির ডাকেই । বিদ্যালয়টির এক সংকট সময়ে বিশেষ প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে আমি কাজে নেমে পড়ি একজন শিক্ষক হিসেবে সেই ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে । শুরু হয়ে যায় আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়, কর্মজীবন । প্রথমে বছর দুয়েক সহকারী শিক্ষক হিসেবে , তারপর সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২৩ বছরসহ সুদীর্ঘ সিকি শতাব্দীকাল আমি বিদ্যালয়টিতে ছিলাম, কাজ করেছিলাম নিরলসভাবে নিখাদ আন্তরিকতা নিয়ে । আমি বিদ্যালয়টিকে দেখেছি তার নানা অবস্থায়, নানা অবয়বে, নানা পর্যায়ে ।..................................বিদ্যালয়টি আছে এবং থাকবে অনাধিকাল ধরে । তার অবিরাম পথচলাতো থেমে থাকতে পারে না , ক্ষান্তি আসতে পারে না মানুষ গড়ার কর্মযজ্ঞে । ’’

সত্যি তো, মানুষ গড়ার কর্মযজ্ঞে আপনি একজন দক্ষ কারিগর ছিলেন । এই কর্মযজ্ঞে কোনো বিরতি, ক্লান্তি, ক্ষান্তি আসতে পারে না ।

তিনি আরো লিখছেন ,আমাদের খাগড়াছড়ি শহরের পুস্তক ব্যবসায়ী ও গণি লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারীকে নিয়ে । ‘‘গণি লাইব্রেরি হচ্ছে খাগড়াছড়ি সদরের অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রাচীনতম । তাঁর দোকানটি ব্যাক্তিগতভাবে আমাকে ও আকর্ষন করে অপ্রতিরোধ্যভাবেই ।কারণ আমিও বই না কিনে থাকতে পারি না । তাই মধ্যে মধ্যে সেখানে আমাকে যেতে হয় । আমার দৃষ্টিতে বইয়ের কারবারটা বেশ গঠনমূলক ও উন্নয়ন সহায়ক হওয়ার কারণে তার একটা আলাদা মূল্য ও তাৎপর্য আছে । আমাদের এই অনগ্রসর অবক্ষয় জর্জরিত সমাজে ব্যবসায়টোকে খাটো করে দেখা সমীচীন নয় । আমরা খাগড়াছড়িতে আছি ।দেখা যাচ্ছে যে, এখানে অতীতে পাওয়া যেত না সেরকম বহু জিনিসই আজকাল পাওয়া যায় তবে আমার ভাবতে খারাপ লাগে যে বিত্তশালীদের ব্যবহার্য লক্ষ লক্ষ টাকা দামের জিনিসের এখানে অভাব নেই, কিন্তু অভাব আছে পুস্তক প্রেমীদের দরকারি বস্তু যৎসামান্য দামের কিচু বইপত্রের ।’’

এমন বইপ্রেমী, জ্ঞান অনুসন্ধিৎসু মনন নিয়ে সারাজীবন জ্ঞানের জগতে বিচরণ করতে ক‘জনই বা পারে । তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি অনেকটা রেনেঁসার হিউম্যানিস্টদের মতো । যাঁদের কাজ শুধু জ্ঞান অনুসন্ধান, চর্চা , সৃষ্টি ও প্রয়োগ করে যাওয়া মানবজাতির জন্য ।

ষাট-সত্তর দশকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যদি পাহাড়ের রাজনৈতিক জাগরণের শিক্ষক হয়, ওই সময়ে এ.বি স্যার ছিলেন পাহাড়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর এবং ছাত্র- শিক্ষক সমাজের আদর্শ । এবং এ .বি. স্যার পাহাড়ে শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে আন্দোলনের গুরু কৃঞ্চকিশোর, চিত্তকিশোর চাকমাদের যোগ্য উত্তরসূরী ।

এমন সাদামাটা জীবন নিয়ে রাজকীয় মৃত্যুবরণ নৈতিকভাবে বড়মাপের মানুষের পক্ষেই সম্ভব । পাহাড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হল ।
মহাপ্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধা রইল ।